বিগত
দুই দশকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনভূমির আয়তন ৬ লক্ষ একরেরও অধিক হ্রাস পাইয়াছে। উদ্ভিদ
জন্মায় দুইটি পদ্ধতিতে-প্রাকৃতিকভাবে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তাহার মধ্যে অধিকাংশ বৃক্ষ
জন্মায় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়, যেইখানে পাখিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। পাখিরা ফল খাইয়া
বীজ দূরদূরান্তে ছড়াইয়া দেয়, যাহা প্রাকৃতিক বৃক্ষবিস্তার নিশ্চিত করে; কিন্তু পাখির
সংখ্যা হ্রাস পাইবার কারণে বীজ বিস্তারের হার কমিয়া গিয়াছে, ফলে নূতন বৃক্ষ জন্মাইবার
হারও কম।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গিয়াছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৭১৫ প্রজাতির পাখি
থাকিলেও, উহার মধ্যে ৫০ প্রজাতি ঝুঁকিতে রহিয়াছে। একদিকে নিরাপদ আবাসস্থলের অভাব, অন্যদিকে
বিষাক্ত খাদ্য, জলাশয় সংকোচন এবং রাসায়নিক ব্যবহারে খাদ্যশৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটাইতেছে। ফলে
পাখি মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হইতেছে। ইহার পাশাপাশি কৃষিজমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশকের
ব্যবহার ছোট মাছ ও পোকামাকড় ধ্বংস করিতেছে, যাহা আবার পাখির খাদ্য উৎস। খাদ্যের অভাব
পাখির মৃত্যুর কারণ হইতেছে এবং পরিবেশে তাহাদের অবদান বিলীন হইয়া যাইতেছে। এই দৃষ্টিকোণ
হইতে বৃক্ষ ও পাখির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়-একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক বনজ জীববৈচিত্র্য
টিকাইয়া থাকিবার জন্য পাখির উপস্থিতি অপরিহার্য। পাখি হ্রাস পাইলে তো প্রাকৃতিকভাবে
বৃক্ষের সংখ্যারও হ্রাস ঘটে। বৃক্ষ হ্রাসের কারণে বিশ্বের নানা দেশ কী কী ধরনের সমস্যায়
পড়িয়াছে, সেই অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। হাইতি, আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া প্রভৃতি দেশে নির্বিচারে
বন উজাড়ের ফলে ভূমিক্ষয়, খরার প্রকোপ এবং কৃষি বিপর্যয় প্রকট হইয়াছে। অন্যদিকে দক্ষিণ
কোরিয়া, কোস্টারিকা ও রুয়ান্ডা সরকার পরিকল্পিত বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম চালাইয়া বনভূমি
পুনরুদ্ধারে সাফল্য পাইয়াছে। বিশেষত দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৭০-এর দশকে 'গ্রিন বেল্ট' কর্মসূচির
মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপণ করিয়া ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করিয়াছে।
বাংলাদেশেও বৃক্ষরোপণের সুদীর্ঘকালের ইতিহাস রহিয়াছে। প্রাচীনকাল হইতেই এই জনপদে গ্রামীণ
মানুষ বট, অশ্বত্থ, আম, কাঁঠাল প্রভৃতি গাছ পারিবারিক প্রয়োজনে রোপণ করিয়া আসিত। ঔপনিবেশিক
যুগে ব্রিটিশরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সেগুন, গর্জন প্রভৃতি বৃক্ষ রোপণ করিয়া বনভূমিকে
করায়ত্ত করে। পাকিস্তান আমলেও বন ব্যবস্থাপনায় কিছু উন্নয়ন হইলেও সেইভাবে সাধারণ মানুষকে
সম্পৃক্ত করা হয় নাই। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৮০-এর দশকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির
সূচনা হয়, যাহা বৃক্ষরোপণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিয়াছে। সরকার জাতীয় বৃক্ষ রোপণ
অভিযান, বৃক্ষমেলা এবং স্কুল-কলেজে সবুজায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে বাস্তবতায় অনেক
পরিকল্পনাই টিকিয়া থাকে নাই অব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতার অভাব ও বনভূমি দখলের কারণে। পরিসংখ্যান
অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫.৫৮ শতাংশ বনভূমি রহিয়াছে, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে ২৫
শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলিয়া বিবেচিত হয়। এই ঘাটতি পূরণ করিতে না পারিলে দেশে মরুকরণ,
গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ, জলাশয়ের সংকোচন এবং ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়িতে থাকিবে। ইহার সহিত
শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়িয়া যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা এবং জনস্বাস্থ্যের অবনতি
ঘটিতে থাকিবে। মনে রাখিতে হইবে, একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ প্রতিদিন গড়পড়তায় ১০০ লিটার
পর্যন্ত অক্সিজেন তৈরি করে, যাহা দৈনিক ৮ থেকে ১০ জন মানুষের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ
করিতে সক্ষম। এই হিসাবে, প্রতিটি গাছ কেবল ভূপ্রকৃতি বা জীববৈচিত্র্য রক্ষার উপাদান
নহে, বরং মানুষ বাঁচাইবার অন্যতম মাধ্যম।
বিজ্ঞানের এই অপার বিকাশের এই যুগে আমরা যদি অধিক সচেতনতার পরিবর্তে আরো অসচেতন হই,
তাহা হইলে তাহা পরিতাপের বিষয় বটে। ইহারই দৃষ্টান্ত হইল, নানা সময়ে বৃক্ষরোপণের বিভিন্ন
ধরনের কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমির আয়তন ৬ লক্ষ একরেরও অধিক হ্রাস
পাইয়াছে। মনে রাখিতে হইবে, গাছ হইল পৃথিবীর নিঃশব্দ অভিভাবক। ইহারা কথা কহে না; কিন্তু
প্রাণ দেয়। সেই নিঃশব্দ প্রাণদাতাদের অবহেলায় হারাইয়া ফেলিলে আমরা কেবল প্রকৃতিকে নহে,
নিজেদের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করিব।
সম্পাদকীয়, ইত্তেফাক
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫
No comments:
Post a Comment