Pages

Monday, April 30, 2018

গাছ উপড়াচ্ছে কার দোষে?


দেশী ঝড় বিদেশি গাছগুলো সইতে পারবে কেন? ২২ এপ্রিলের পর বুধবার, তারপরও আরো কয়েকবার রাজধানীতে আঘাত হানল কালবৈশাখী। লন্ডভন্ড হলো নগরের গাছপালা। চন্দ্রিমা উদ্যান আর গণভবনের পাশে সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজার উঁচুমাথা সেয়ানা সেয়ানা গাছ যেভাবে লন্ডভন্ড হলো, তাতে গোটা বৃক্ষায়নপদ্ধতিই প্রশ্নবিদ্ধ। ‘গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও’—এই স্লোগান দিয়ে যাঁরা গত চার দশকে গোটা বাংলাদেশ বিদেশি গাছে ছেয়ে ফেলেছেন আর নির্বাসনে পাঠিয়েছেন দেশীয় গাছপালা, তাঁরা কী জবাব দেবেন তা জানি না। পরিবেশ রক্ষায় গাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছ হলো জীবনের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন কারখানা। 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশের আবহাওয়ায় খাপ খায় এমন স্বাভাবিক গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখা। পরিবেশ রক্ষার নামে বিদেশ থেকে ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া, ইপিলইপিল এনে কেন আমাদের দেশীয় বৃক্ষ অথবা শত শত বছরে খাপ খেয়ে যাওয়া গাছগুলোকে নির্বাসনে দেওয়া হলো, তার জবাব দেওয়ার কেউ নেই বন বিভাগ বা সরকারের কোনো দপ্তরে। অথচ বন ও পরিবেশ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় আছে আমাদের। তাদের কাজ বন ও পরিবেশ রক্ষা, নাকি সংহার করা, তারও কোনো সদুত্তর দেশবাসী জানে না।

চন্দ্রিমা উদ্যানে ২২ এপ্রিলের ঝড়ে তিন শতাধিক গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ১০০ গাছ উপড়ে পড়েছে। মানছি, ঝড়ের বেগ এরা সামলাতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে সমূলে উৎপাটিত হওয়ার মতো ঝড়ের গতিবেগ সেদিন ছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠবেই। গত বছরও গণভবন এলাকা ও রেসিডেন্সিয়াল কলেজের বেশ বড় বড় গাছ উল্টে পড়েছিল। চন্দ্রিমা উদ্যানে যেসব গাছ ভেঙেছে, উপড়ে পড়েছে, তার বেশির ভাগই একাশিয়া আর বোটলব্রাশ। কিন্তু সেখানে দেশি দেবদারু দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। আরবরি কালচারের বাগানে উল্টে বা ভেঙে পড়েছে বড় বড় চম্বলগাছ। বোটলব্রাশ বা একাশিয়া বেশ শক্ত-সামর্থ্য বৃক্ষ প্রজাতি। চম্বলও একেবারে কলা, পেঁপে বা শজনের মতো অশক্ত কোনো প্রজাতি নয়, যদিও বিশালাকৃতির তুলনায় তারা বেশ দুর্বল। আবহাওয়া অফিসের বরাতে জানা গেছে, সেদিন ঢাকায় যে ঝড় বয়ে যায়, তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮৪ কিলোমিটার। হিসাবের পাল্লায় ঢাকার এ ঝড় ছিল ‘হালকা মাত্রা’র (গওহার নঈম ওয়ারা, প্রথম আলো, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮)। এমন হালকা মাত্রার ঝড়ে যদি বিশাল বিশাল বৃক্ষ উৎপাটিত হয়, তবে গোটা বৃক্ষ নির্বাচন ও রোপণপদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। ভারী বা প্রচণ্ড মাত্রার (ঘণ্টায় ১২১ থেকে ১৪৯ কিলোমিটার বেগে) ঝড় আঘাত হানলে কী হতো কে জানে?

বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা স্থানীয় জন-জ্ঞানকে অস্বীকার করার প্রবণতা। আরও একটি সমস্যা, যা কিছু স্থানীয় তার সমূল উৎসাদনে একশ্রেণির উন্নয়নবিশারদদের অতি উৎসাহ। স্বাধীনতার আগে আর পরের বাংলাদেশের দিগন্তরেখা একেবারে বদলে গেছে। না, শুধু সুন্দরবন, মধুপুর, ভাওয়াল, চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট, দিনাজপুরের বনরাজির কথা বলছি না; বলছি, উন্নয়নবিদদের অতি তৎপরতায় গোটা দেশ ভরে গেছে একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, ইপিলইপিল, মেহগনিতে। এর মধ্যে একমাত্র মেহগনি ছাড়া আর কোনো বৃক্ষ এ দেশে দ্রুত অভিযোজিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাই বলে দেশটা কেন মেহগনিতেই ছেয়ে ফেলতে হবে? কাঠ দামি বলেই কি? আর উজাড় করতে হবে এ দেশের প্রাচীনতম লালমাটির ভাওয়াল, মধুপুর, সাভারের শালসমৃদ্ধ বনভূমি? শাল বিনাশ করে একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, ইপিলইপিল, মেহগনি লাগানোর কী যুক্তি আছে? ভুলে গেলে চলবে না, বৃক্ষায়নের এই মহাযজ্ঞে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোই নেতা। সাধারণ মানুষ কিন্তু সাধারণ জ্ঞানেই তা উপেক্ষা করে গেছে। একশ্রেণির তথাকথিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তো কাজই হলো দেশীয় জনজ্ঞানকে তাচ্ছিল্য করা, আর ‘পশ্চিমা উন্নত জ্ঞানের বিস্তার’ ঘটানোর নামে অর্থ লুটপাটের ব্যবস্থা করা। তারা সেটা সাফল্যের সঙ্গেই সম্পন্ন করে চলেছে।

চন্দ্রিমা উদ্যানে বৃক্ষ উৎপাটনের মূল কারণ, আমার মতে, ভুল প্রজাতি নির্বাচন ও রোপণে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ। বৃক্ষায়নে অনেক বৈজ্ঞানিক বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। যেমন: স্থান নির্বাচনে মাটির প্রকার ও ধরন, প্রাপ্য পরিসর, প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ, প্রতিপার্শ্ব ইত্যাদি। বৃক্ষর প্রজাতি নির্বাচনে বিবেচনা করতে হবে প্রজাতির গড় উচ্চতা, কাণ্ডের ধরন ও শাখায়নের ভঙ্গি, প্রশাখাগুলো কতটা পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখার শক্তিসামর্থ্য ইত্যাদি। একটি বৃক্ষ তার মূল মাটির কত গভীরে প্রোথিত করে ও দূরত্বে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাও। যেমন: বটবৃক্ষের জন্য বিপুল পরিসর প্রয়োজন; তাই সড়ক বিভাজকে যাঁরা বট-অশ্বত্থ, কদম, বা চম্বল লাগাতে চান, তাঁদের মূর্খ বললেও কম বলা হয়। আবার বটের মূল খুব বেশি গভীরে প্রবেশ করে না। তাই সে ঠেসমূলের সাহায্য নেয়। সেটা সে তৈরি করে প্রথমে ঝুরি নামিয়ে। কর্তাদের আবার ঝুরি অপছন্দ। তাই তাঁরা যখন ঝুরি কেটে সাবাড় করেন, তখন বটের জীবনই বিপন্ন করেন মাত্র। চম্বল উঁচু বৃক্ষ, শাখায়নের ভঙ্গি ঊর্ধ্বমুখী; তার শাখা-প্রশাখা যত মোটাসোটা, শক্তি-সামর্থ্যের তত নয়। কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল বলে জ্বালানি হিসেবে চট্টগ্রাম, বাগেরহাট এলাকায় তার ব্যাপক রোপণ লক্ষ করা যায়। কদম দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষের একটি, কিন্তু তার কাঠ একবারেই নরম। রাস্তা, নানা রকম ইউলিটি লাইন নির্মাণসহ নানা কাজে নগরে খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে। আর খোঁড়াখুঁড়ি যেখানে বেশি, সেখানে এমন বৃক্ষরোপণ নিতান্ত বোকামি। আমরা নগর বৃক্ষায়নে এসব কথা বিবেচনা করি না। শুধু কি নগরে? সারা দেশে সড়ক ও রেলপথের ধারে, বসতবাড়ি, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতের পার্শ্বজুড়ে নির্বিচার গাছ লাগিয়ে আমরা বাহাদুরি নিতে পাগল। কিন্তু বিজ্ঞানের কথা বিবেচনা করি না।

তবে সবচেয়ে মূর্খামি করি আমরা ছোট চারার পরিবর্তে বড়সড় চারা রোপণ করে। তাতে নেতাদের রাতারাতি উন্নয়নের লম্বা দাঁত দেখানোর মওকা মেলে, ঠিকাদারের লাভ হয় বেশি, আর নাগরিকের হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি। চারা বড় হলে তার ট্যাপরুট না কেটে নার্সারি থেকে তোলা যায় না। আর ট্যাপরুট কাটার অর্থই হলো গাছের মূল মাটির গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। গাছ যত বড় হবে, তার মূল যেতে হবে মাটির তত গভীরে। কিন্তু তারপরও সে তার অন্যান্য শিকড় চারদিকে ছড়িয়ে দেবে যেন সে দরকারি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে, আর ঝড়-ঝাপটা সামাল দিয়ে টিকে থাকতে পারে। তাই যে গাছের ট্যাপরুট কেটে লাগালেন, সে হালকা ঝড়ে ভেঙে পড়বেই। চন্দ্রিমা, আরবরি কালচার উদ্যান বা রেসিডেন্সিয়াল কলেজে আমরা তাই দেখলাম মাত্র।
আমরা উন্নয়ন চাই, কিন্তু লোকদেখানো, কসমেটিক উন্নয়ন চাই না।


আমিরুল আলম খান, যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

source

No comments:

Post a Comment